top of page
Search
  • Writer's pictureমহর্ষি মহামানস

ভাগ্য আসলে কী




প্রসঙ্গ : ভাগ্য

— মহর্ষি মহামানস


(ভাগ্যকে আরো ভালোভাবে বুঝতে, মহর্ষি মহামানস -এর সর্বাধুনিক সৃষ্টিতত্ত্ব--- ‘মহাবিশ্ব সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন’ পড়ুন)


সব কিছুর মূলে রয়েছে ভাগ্য, ভাগ্যই সব কিছুর জন্য দায়ী। আর এই ভাগ্য পূর্ব নির্ধারিত এবং অপরিবর্তনীয়। তবে, ভাগ্যকে কার্যকর ফলবৎ হতে, বিভিন্ন কার্য-কারণের ভিত্তিতে যুক্তি-বিজ্ঞানের পথ ধরেই অগ্রসর হতে হয়। ভাগ্যের জন্যেই আমরা কেউ সুখী -কেউ দুঃখী, কেউ সফল –কেউ অসফল৷ ভাগ্যের জন্যেই আমাদের এত দুঃখকষ্ট-যন্ত্রনা। তাই, ভাগ্যকে খুব ভালোভাবে জানা প্রয়োজন৷


জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতার কারণে ভাগ্য এবং তার গতিবিধি সহ সমস্ত কার্য-কারণ যুক্তি-বিজ্ঞান আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়না। আবার কখনো কিছু অংশে দৃষ্টিগোচর হলেও তার প্রতিকার দৃষ্টিগোচর বা ধারণাগত হয়না, অথবা প্রতিকার সম্ভব হয়ে ওঠেনা৷ ফলে, আমরা অসহায়ের মতো দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগ করে থাকি, অসফল ব্যর্থ ক্ষতিগ্রস্ত হই৷ মনে রাখতে হবে, আমরা এবং আমাদের যাবতীয় কার্যকলাপ, সবই ভাগ্যের দান৷ আমরা কেউই ভাগ্য প্রসুত ঘটনা প্রবাহের বাইরে নই। তাই, আমাদের কর্তব্য ভাগ্যকে তার স্বরূপে জানা।


ভাগ্য আসলে কী? ভাগ্য হলো- কোনো ঘটনার মধ্য দিয়ে স্বতঃসম্ভুত একপ্রকার শক্তি বা প্রোগ্রাম রূপ নির্দেশ, যা অবশ্যম্ভাবি ভাবী ঘটনা বা ঘটনাবলীর অমোঘ নির্ধারক ও নিয়ামক। অনুরূপভাবে- জাগতিক বা মহাজাগতিক ক্ষেত্রে: ভাগ্য হলো- আদি মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে জগৎ সৃজন শুরু হওয়ার মুহূর্তে উৎপন্ন হওয়া – অবশ্যম্ভাবি ভাবী ঘটনাবলীর নির্ধারক ও নিয়ামক রূপ একপ্রকার অনৈচ্ছিক শক্তি অথবা স্বতঃসৃষ্ট প্রোগ্রাম৷ এছাড়াও, ব্যবহারীক অর্থে- পূর্বনির্ধারিত ঘটনা অথবা পূর্বনির্ধারিত পরম্পরাগত অবশ্যম্ভাবি ঘটনা বা ঘটনাবলীকেও ভাগ্য বলা হয়। প্রতিটি ঘটনা সৃষ্টি রূপ প্রতিটি উৎপাদন, তার সাথে সম্পর্কযুক্ত পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনা বা সৃষ্টির আপাত কারণ। যা সৃষ্টির শুরুতে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই পূর্বনির্ধারিত হয়ে আছে।


সৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথেসাথেই এই ভাগ্য অস্তিত্ব সম্পন্ন হয়ে ওঠে। তখনই ঠিক হয়ে যায় কখন কোথায় কেমন ভাবে কি ঘটবে। জগতের সর্বত্র বিস্তৃত প্রম্পরাগত অবশ্যম্ভাবী ঘটনা প্রবাহ। ঈশ্বর অর্থাৎ এই মহাবিশ্ব রূপ অস্তিত্বও ভাগ্যের অধীন। ঈশ্বরের সমস্ত কার্যকলাপও ভাগ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বলাযায়, ভাগ্য ঈশ্বরের থেকেও বলবান৷


বোঝাবার সুবিধার্থে, একটি সহজ নিদর্শন দিয়ে বলি, একটি তীরের ফলক যুক্ত ঘূর্ণমান চক্রের ঘুর্ণনক্রিয়া শুরু হওয়ার সাথেসাথেই স্বতঃই নির্ধারিত হয়ে যায়, তীরের ফলকের তীক্ষ্ণ কোণটি কখন এবং ঠিক কোথায় গিয়ে স্থির হবে৷ এ-ই হলো ভাগ্য এবং পূর্বনির্ধারিত ঘটনা। মহাসৃষ্টি বা জাগতিক ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রায় অনুরূপ। সৃষ্টির শুরুতে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে।


ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত! তত্ত্বগত ভাবে একথা আমরা মেনে নিলেও, জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতার কারণে আমাদের পক্ষে বিশদভাবে জানা সম্ভব নয়, সেখানে কোন সময়ের জন্য কোন ঘটনা নির্দিষ্ট হয়ে আছে। কখনো কখনো সম্ভাব্য কোনো ঘটনার পরিবর্তন লক্ষ্য করে, অথবা পরিবর্তন ঘটিয়ে আমরা ভাগ্য পরিবর্তনের ধারণা লাভ করে থাকি। কিন্তু, এটা সম্পূর্ণতঃ আমাদের অজ্ঞতা প্রসূত ধারণা। যে ঘটনার সম্ভাবনা আমরা অনুমান করছি তা নিছকই অনুমান৷ যা ঘটছে বা ঘটেছে তাই হলো বাস্তব সত্য।


যদিও, যা ঘটছে আর যা ঘটেছে, এই বাস্তব সত্যকেও আমরা অনেক সময়েই আমাদের জ্ঞান-চেতনার স্বল্পতার কারণে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারিনা বা ধারণায় আনতে পারিনা। তাই, শুধু দৃশ্যতঃ যা ঘটেছে যা ঘটছে তাকেই অবশ্যম্ভাবী পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য বলে মেনে নিই আমরা৷


ভাগ্য আমাদের ভিতরে বাইরে, জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দিক থেকে ক্রিয়াশীল। আমাদের চিন্তা-ভাবনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা সহ আমাদের সমস্ত কার্যকলাপ ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং তা জাগতিক কর্মকান্ডেরই অংশ। আমরাও এই জগতেরই একটা অংশ৷ এখানে, ভাগ্যক্রমে বা ঘটনাক্রমে কেউ ধনী -কেউ দরিদ্র, কেউ মহৎ আবার কেউ অসৎ। তা-ই বলে এর পিছনে কোনো নিয়ন্তা বা নির্ধারক ও নিয়ামক চেতন সত্তা নেই, আছে সতঃসৃষ্ট এক যান্ত্রিক প্রোগ্রাম।


যথেষ্ট জ্ঞান-চেতনা ও ক্ষমতা বলে কেউ যদি তাকে কেন্দ্র করে ঘটমান ঘটনাপ্রবাহের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়, বুঝতে হবে, ভাগ্যক্রমেই তা ঘটেছে, অর্থাৎ সেটাই ঘটার ছিল।


আমাদের অসহায়তার মুলে ভাগ্য দায়ী হলেও জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতাই তার অন্যতম কারণ। তাই জাগতিক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা প্রভৃতি থেকে মুক্তি পেতে জ্ঞান ও চেতনার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা সহ জ্ঞানী ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহন আশু কর্তব্য।


কিন্তু, জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতার কারণেই আমরা বুঝে উঠতে পারিনা কে প্রকৃত জ্ঞানী আর কে ভন্ড-প্রতারক। কোনটা জ্ঞান আর কোনটা নয়, কিসে আমাদের প্রকৃত মঙ্গল হবে বুঝতে পারিনা। ফলে, আমরা অসহায়ের মতো দিগবিদিগ জ্ঞানশূণ্য হয়ে ছোটাছুটি করি এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভন্ড গুরু, জ্যোতিষী ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের করতলগত হয়ে আরো বেশী দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগ করি।


যদিও এই ভাবেই জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে তিলেতিলে আমাদের চেতনার বিকাশ ঘটে থাকে। অনেক সময়েই জ্ঞানীর সদুপদেশের পরিবর্তে ভন্ড-প্রতারকের কু-পরামর্শই আমাদের কাছে গ্রহনযোগ্য মনে হয়৷ জ্ঞানীর সুপরামর্শ আমাদের মনঃপুত হয়না।

ভাগ্য, ঈশ্বর তথা জাগতিক ব্যবস্থা শুধু আমাদের ভালোই চায়, -এই রকম ভুল ধারণা আমাদের অনেকের মধ্যেই আছে। ভাগ্যকে অনেকেই ঈশ্বরের ইচ্ছা জ্ঞানে- বলে থাকে, “ঈশ্বর যা করেন আমাদের ভালোর জন্যেই করেন। হ্যাঁ, ঈশ্বরের ইচ্ছা- সেও আসলে ভাগ্যেরই সৃষ্টি। ভাগ্যেরই প্রকাশ। কিন্তু তাই বলে- ঈশ্বরই ভাগ্য-বিধাতা নয়৷ এই মহাজগৎ বা মহাবিশ্বরূপ সত্তাই হলো – ঈশ্বর।

এ হলো এক বিচিত্র বৈপরীত্যে ভরা অদ্ভূত জগত। যে ব্যক্তি অন্যায়-অপরাধ -কুকর্ম করছে, ভাগ্যই তাকে দিয়ে তা করাচ্ছে। যে অপরাধী- সে অপরাধ করতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থাৎ ভাগ্য তাকে বাধ্য করাচ্ছে অপরাধ করতে। অপরাধ না করে তার উপায় নেই। আবার যে ভালো কাজ করছে, সেও বাধ্য হচ্ছে তা করতে। যে অপরাধীকে ধরছে এবং যে অপরাধীকে শাস্তি দিচ্ছে, ভাগ্যই তাদের দিয়ে তা করাছে। কুকর্ম করেও অনেকে শাস্তি ভোগ করছে না, আবার সুকর্ম করেও শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে অনেককে।


এই পক্ষপাতিত্বের সঠিক কারণ খুঁজে না পেয়ে, অনেকেই পূর্বজন্মের কর্মফলের কাল্পনিক তত্ত্ব হাজির করে থাকে। কিন্তু তা-ই যদি হয়, তাহলে অতি নিম্ন-চেতন স্তরের যে জীবটিকে হত্যা করে আমরা তার মাংস খাচ্ছি, -তার সুকর্ম-কুকর্ম, দোষ-গুণ –অপরাধ -কর্মফলের হিসেবটা কিরকম হবে? আর তার এই করুণ পরিণতিতে সেই জীবটির কি ভালো হতে পারে?!


ঈশ্বর, ভাগ্য এবং এই জাগতিক ব্যবস্থা কারোই জীবের জন্য কিছুমাত্র মাথাব্যাথা নেই। ঈশ্বর তার শৈশব ও কৈশোরের ছেলেখেলায়- যখন জীব সৃষ্টির শখ হয়েছিল, সেইসময় জীবের প্রতি তার কিছুটা নজর থাকলেও, জীবের উপর সুবিচার করেনি সে কখনোই৷ জীবকে জীবের খাদ্যে পরিণত করাটাই তার বড় প্রমাণ। ঈশ্বরের বয়স বৃদ্ধির সাথেসাথে- জ্ঞান ও চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে আস্তে আস্তে খেলা-ধুলার পাট চুকে যাওয়ার পর, পুতুল খেলার শখ মিটে গেলে- জীব তখন শৈশবের খেলাঘরে অনাদরে পড়ে থাকা আবর্জনার স্তুপ বৈ আর কিছু নয়।


ঈশ্বরকে যতই ডাকো- যতই তার কাছে কাতর প্রার্থনা জানাও, তাতে সে বিরক্তই হবে, ভক্তের উপর সদয় হবেনা সে কখনোই৷ বর্তমানে আমাদের মাথার উপরে কোনো শাসক নেই কোনো সহায়কও নেই। আছে আমাদের চারিপাশে বিস্তার করে থাকা অধিকাংশে অদৃশ্য -ভাগ্যের জাল। অজ্ঞান-অন্ধত্ব -চেতনাভাবের কারণে আমরা সম্পূর্ণ ভাগ্যের অধীনস্ত হয়ে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগ করে চলেছি। আমাদের জ্ঞান ও চেতনার যথেষ্ট বিকাশ ঘটলেই আমরা ভাগ্যের হাত থেকে বহুলাংশে মুক্ত হতে পারবো।


তাহলে জীবজগৎ টিকে আছে কি করে? দুঃসহ সব কঠিণ অবস্থার মধ্য দিয়ে- ঈশ্বর প্রদত্ত শরীর-মন এবং তার মধ্যে অন্তগ্রথিত নির্দেশ বা ‘প্রোগ্রাম’ সম্বল করে, অনেক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা সয়ে- প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে জীব টিকে আছে এই জগতে। ঘটনাচক্রে -ভাগ্যক্রমেই সে টিকে আছে। যে সমস্ত জীব পরিবর্তীত প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিতে অক্ষম হয়েছে, তারা হারিয়ে গেছে এই কঠিণ নিষ্ঠুর জগৎ থেকে।


এই জগতে যা কিছু ঘটছে- সবই ঘটনাক্রমে বা ভাগ্যক্রমে ঘটে চলেছে। এখানে এর ব্যতীক্রম ঘটনোর সাধ্য নেই কারো। একমাত্র, উচ্চ চেতনা সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। তার পর্যাপ্ত জ্ঞান ও চেতনার দ্বারা নিজেকে ভাগ্যের বন্ধন থেকে অনেকাংশে মুক্ত করতে সক্ষম৷ তাই, ‘ভাগ্য জীবের ভালোই চায়, ভাগ্যকে মেনে নিলে আমরা অনেক ভালো থাকতে পারবো, কিম্বা ভাগ্য যাকে যেদিকে নিয়ে যেতে চায় সে দিকে গেলেই তার ভালো হবে।' -সব সময়েই এই সাধারণ সরল হিসেব সমান কার্যকর হয়না। ঘটানাক্রমে কখনো ভালো হতেও পারে- কখনো নাও হতে পারে।


এইসব দেখে-শুনে, স্বভাবতঃই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে- তাহলে, প্রকৃতই ভাগ্য কী চায়? -ভাগ্যকে বুঝতে, - তার কার্যকলাপকে বুঝতে, তার জন্ম লগ্নের দিকে ফিরে তাকাতে হবে আমাদের।


মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই সৃষ্টির শুরু, আর সেই বিস্ফোরণের ক্ষণটিতেই জন্ম নেয় ভাগ্য৷ যেমন, একটি বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ঘটে থাকে একের পর এক নানা ঘটনা। বিস্ফোরণের মূহুর্তেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়। তারপরে কি ঘটবে, এবং তারও পরে পরম্পরাগতভাবে একের পর এক কি-কি ঘটতে থাকবে। এই জগতে। যা কিছু ঘটছে এবং যা কিছু ঘটবে সে সমস্ত কিছুই নির্ধারিত হয়ে গেছে - বিস্ফোরণের মুহুর্তে প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এখানে প্রায়' কথাটি বলছি এই জন্যে যে বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে এর পিছনে ছিলো - ইচ্ছাশক্তি ও স্থান-কাল এবং পাত্র হলো বিস্ফোরক বস্তুটির গঠণ-উপাদান প্রভৃতি।


বিস্ফোরণ পরবর্তী পরম্পরাগত ঘটনাগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে একের পর এক ঘটতে থাকলেও, এদের মধ্যে পূর্বোক্ত সেই ইচ্ছাশক্তি- যে ইচ্ছাবলে বিস্ফোরণটি ঘটেছিলো, সেই ইচ্ছা প্রচ্ছন্নভাবে সক্রিয় আছে।


আমরা জানি, মহাজগৎ সৃষ্টির পিছনে রয়েছে আদি ইচ্ছা - আদি উদ্দেশ্য এবং তাকে সফল করে তোলার পরিকল্পনা (‘মহাবিশ্ব-সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন’ দ্রষ্টব্য)। এছাড়াও, আমরা এই মহাজাগতিক ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে পুনরায় ইচ্ছাশক্তির বিকাশ ঘটতে দেখেছি৷ প্রথমে তার প্রকাশ ঘটেছে- ঈশ্বর মনের মধ্য দিয়ে, এবং তার পরবর্তীতে জীব প্রভৃতি ঈশ্বরের অংশ থেকে সৃষ্ট হওয়া ঐচ্ছিক সত্তার মধ্য দিয়ে। সেই আদি ইচ্ছা- আদি উদ্দেশ্য হলো - আত্মবিকাশ লাভ!


সমস্ত সৃষ্টি এবং তার জাগতিক ঘটনাবলীর মধ্যে- ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক উভয় প্রকার শক্তিই ক্রিয়াশীল রয়েছে। ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক শক্তি সম্মিলিতভাবে সমস্ত জাগতিক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। ভালো করে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে- কখনো ঐচ্ছিক শক্তি থেকে অনৈচ্ছিক শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে, আবার কখনো অনৈচ্ছিক শক্তি থেকে ঐচ্ছিক সত্তা বা শক্তি জন্ম নিচ্ছে। তবে, এ জগতে কোনো শক্তিই পুরোপুরি ঐচ্ছিক অথবা পুরোপুরি অনৈচ্ছিক নয়। অনৈচ্ছিক শক্তির মধ্যে অল্প হলেও ঐচ্ছিক শক্তি নিহিত আছে। আবার ঐচ্ছিক শক্তির মধ্যেও অল্প-স্বল্প অনৈচ্ছিক শক্তি নিহিত রয়েছে। এখানে কোনো ঘটনাই- ঐচ্ছিক শক্তির দ্বারা অথবা অনৈচ্ছিক শক্তির দ্বারা সর্বাংশে নিয়ন্ত্রিত ও সৃষ্ট নয়। আর এটাই হলো আমাদের ক্ষেত্রে জাগতিক সমস্যার অন্যতম একটি কারণ।


সবসময়- সর্বক্ষেত্রে- ঈশ্বর বা জীবের ইচ্ছামতো সবকিছু ঘটা সম্ভব নয় এখানে। তারপর, ঈশ্বর এবং আমাদের ইচ্ছাও অনেকাংশে অনৈচ্ছিক শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। তবে যা কিছু ঘটছে- সবই পূর্বনির্ধারিত ভাবে ঘটে চলেছে, এবং এর পিছনে প্রচ্ছন্নভাবে আদি-ইচ্ছা কাজ করছে। ঈশ্বর এবং আমাদের ইচ্ছা এবং সেই ইচ্ছামতো আমাদের যাবতীয় কার্যকলাপ —সবই ভাগ্যক্রমে পূর্বনির্ধারিত মতো ঘটে চলেছে।


ঈশ্বর- জীবের স্বার্থে জীবের মঙ্গলের জন্যে বিশেষ কিছু করেনা। সে যা কিছু করে, সবই নিজের স্বার্থে – নিজের প্রয়োজনে৷ সেই প্রয়োজন মেটাতে গিয়েই কখনো জীবের মঙ্গল হয়, আবার কখনো ক্ষতি হয়। কখনো কারো ভালো হয় তো কখনো কারো ক্ষতি হয়৷ অংশানুক্রমে ঈশ্বর সৃষ্ট জীবও তাই এত স্বার্থপর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, জীবও নিজের যৌন চাহিদা মেটাতে গিয়েই ঘটনাক্রমে সন্তানের জন্ম দেয়। জাগতিক ব্যবস্থা কারো স্বার্থ দেখেনা৷ সে হলো- নিরপেক্ষ এক অনৈচ্ছিক যান্ত্রিক ব্যবস্থা৷ সেই যান্ত্রিক ঘটনাচক্রে কখনো কারো ভালো হয়, আবার কখনো কারো মন্দ হয়। যে এই যান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে যতটা ওয়াকিফহাল, সে ততটাই স্বাধীন।


ঈশ্বর তার প্রয়োজনানুগ কর্মও কিন্তু সবসময় পুরোপুরি নিজের ইচ্ছামতো করতে পারেনি— পারেনা৷ কখনো শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর তৈরী হয়েছে, আবার, কখনো বাঁদর তৈরী করতে গিয়ে শিব তৈরী হয়ে গিয়েছে। তাই জীবের দুঃখ-কষ্টযন্ত্রনার জন্য সবসময় ঈশ্বরকেও পুরোপুরি দায়ী করা যায়না। আমরা যেমন অসহায়, তেমনি ঈশ্বরও তার সেই নিম্ন-চেতন স্তরে ছিলো অসহায়। তারও সহায় নেই কেউ। তাই এই মহাসৃষ্টিকে এক মহা অনাসৃষ্টিও বলা যেতে পারে৷


তবে, যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনার অভাবই হলো এই অসহায়তার অন্যতম কারণ। ঈশ্বর যখন জীব সৃষ্টি করেছিলো তখন তার জ্ঞান ও চেতনা ছিল এখনকার তুলনায় খুবই কম। আবার, এখন সে যে উচ্চ-চেতন স্তরে পৌচেছে, - সেখান থেকে সেই শৈশব ও কৈশোরের ছেলেখেলায় সে আর আগ্রহী নয়। সে এখন মোহ-মায়া থেকে অনেকটাই মুক্ত।


পূর্বনির্ধারিত অবশ্যম্ভাবি ঘটনার মধ্যে পরিবর্তন আনতে হলে- সমগ্র ঘটনা প্রবাহের বাইরের থেকে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। ঘটনাপ্রবাহের মধ্য থেকে কোনোরূপ শক্তি প্রয়োগের দ্বারা সেই ঘটনা প্রবাহের অন্তর্গত কোনো ঘটনার পরিবর্তন সাধিত হলে, তা পূর্বনির্ধারিত ঘটনাক্রমেই সংঘটিত হয়েছে বলে বিবেচিত হবে।


জাগতিক বা মহাজাগতিক প্রতিটি ঘটনাই- মহাজগৎ ব্যাপী বিস্তৃত ঘটনাপ্রবাহের অন্তর্গত। মহাজগতের আভ্যন্তরীণ সমস্ত ঘটনাই মহাজাগতিক ভাগ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সংঘটিত হয়ে থাকে। তাই, জাগতিক কোনো ঘটনার পরিবর্তন ঘটাতে হলে, তার জন্য এই মহাজগতের বাইরের থেকে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে, যা মোটেই সম্ভব নয়।


ভাগ্য নামে- ভাবী ঘটনাবলীর নির্ধারক ও নিয়ামক শক্তি বা প্রোগ্রাম’-টি উৎপন্ন হওয়ার সময়, অর্থাৎ মূল ঘটনা ঘটার সময়- সেই ঘটনার সাথে বা পিছনে যদি কোনো উদ্দেশ্যমূলক ঐচ্ছিক শক্তি থাকে, অথবা কাজ করে, সেক্ষেত্রে, ভাগ্য রূপ অনৈচ্ছিক শক্তি বা প্রোগ্রাম’-টির সাথে সেই ইচ্ছাশক্তি অথবা ইচ্ছা রূপ প্রোগ্রাম'-টি যুক্ত হয়ে, ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক উভয় শক্তি বা প্রোগ্রামের সমন্বয়ে ভাগ্য রূপ ‘প্রোগ্রাম'-টি গঠিত হয়ে থাকে। তারফলে শুধু অনৈচ্ছিক প্রোগ্রাম বা নির্দেশের দ্বারা যেরূপ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কথা – ঠিক সেইরূপ না হয়ে, উভয়ের বলাবল সাপেক্ষে, অনৈচ্ছিক ও ঐচ্ছিক প্রোগ্রামের মিলিত ক্রিয়ায় ভাবী ঘটনাবলী ভিন্নরূপ হয়ে থাকে।


মহাজগতের ভিতর থেকে মহাজাগতিক ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। ভাগ্য রূপ প্রোগ্রাম'-টি অপরিবর্তনীয় হলেও, -এই ভাগ্যের দ্বারা সংঘটিত মহাজগৎ ব্যাপী বিস্তৃত অসংখ্য ঘটনাবলী কিন্তু সততই পরিবর্তনশীল। তবে, এই সতঃসৃষ্ট অনৈচ্ছিক শক্তি সম্পন্ন ভাগ্য বা ‘প্রোগ্রাম’-এর সাথে যদি কোনো ইচ্ছাশক্তি অথবা ঐচ্ছিক প্রোগ্রাম যুক্ত থাকে, তার জন্মের সময় থেকেই যুক্ত হয়ে থাকে, সেই ইচ্ছাশক্তি রূপ প্রোগ্রাম বা ঐচ্ছিক প্রোগ্রাম অনুসারে নির্দিষ্ট বিশেষ কো্নো সময়ে বা সময় গুলিতে এই ভাগ্যের পরিবর্তন সাধিত হতে পারে।

যেমন, সেই ঐচ্ছিক প্রোগ্রামের মধ্যে যদি এইরূপ কো্নো নির্দেশ থাকে, যে ঈশ্বর এবং ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন জীব বা কো্নো সত্তা কালক্রমে উচ্চ-চেতনা সহ প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন হয়ে উঠলে, তখন তারা তাদের পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে। অথবা ভাগ্যের বন্ধন থেকে অনেকাংশে মুক্ত হতে পারবে, সেক্ষেত্রে, সেই নির্দেশ কার্যকর হবে।


শেষ করার আগে, আমি আমার অনুগামীদের উদ্দেশে বলব, তাৎক্ষণিক লাভের আশায় ভাগ্য বা ঈশ্বর অথবা কোনো দৃশ্য বা অদৃশ্য সত্তার দয়া বা কৃপা লাভের পিছনে না ছুটে, নিজের আত্মবিকাশ বা মনোবিকাশের জন্য তৎপর হও, সর্বাঙ্গীন সুস্থতা লাভের জন্য উদ্যোগী হও। তাহলেই ক্রমশ তোমরা দুর্ভাগ্য থেকে অনেকাংশে মুক্তিলাভ করতে পারবে, সেই সাথে অজ্ঞানতার বন্ধন থেকেও মুক্তিলাভ ঘটবে তোমাদের।


একদিক থেকে দেখলে, দুর্ভাগ্য আর কিছুই নয়, তোমাদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ঘষে-মেজে খাঁটি সোনায় পরিণত করার এক নিষ্ঠুর জাগতিক প্রক্রিয়া। কিন্তু তোমরা যদি নিজের থেকেই খাঁটি সোনা হয়ে ওঠার উদ্যোগ নাও, আত্মবিকাশের উদ্যোগ নাও, তাহলে দুর্ভাগ্য তোমাদের কী করবে! দুর্ভাগ্যের জন্য মূলতঃ দায়ী করো নিজেকে, এবং দুর্ভাগ্যের অসাফল্যের কারণ গুলি অনুসন্ধান করো নিজের মধ্যে। দোষ ত্রুটি –ঘাটতি, অজ্ঞানতা অসুস্থতা -ঋণাত্মকতা প্রভৃতি কারণ গুলিকে একে একে চিহ্নিত করে তারপর সেই কারণ গুলির অপসারণ ঘটাতে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নাও। নিজের মধ্যে শুভ পরিবর্তন ঘটাতে পারলে, তোমাদের ভাগ্যেরও শুভ পরিবর্তন ঘটবে। তবে এগুলি করতে পারলে, বুঝতে হবে তা’ ভাগ্যক্রমেই করেছো, এবং সেক্ষেত্রে তুমি সৌভাগ্যবান।


যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনার অভাবেই আমরা এত অসহায়। সমস্যা কোথায়- বিপদ কোন দিক থেকে আসছে এবং তার মোকাবিলা করতে অথবা তার থেকে নিস্তার পেতে কি করা কর্তব্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আমাদের ধারণা ও জ্ঞানের অতীত হওয়ায় আমরা এত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগ করে থাকি। যা করলে দুঃখ-কষ্ট পাবো যাতে আমাদের ক্ষতি হবে, অনেক সময়ে আমরা তা-ই করে থাকি। তাই এর থেকে রেহাই পেতে আমাদের একমাত্র কর্তব্য জ্ঞান ও চেতনা লাভের জন্য সচেষ্ট হওয়া। একমাত্র, যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনাই আমাদের মুক্তি দিতে সক্ষম। অথচ আমরা অজ্ঞান-অন্ধত্বের কারণে তা’ না করে, অজ্ঞানের সাধনা করে চলেছি, যাতে আরো বেশী করে মোহ-মায়ার জালে জড়িয়ে পড়ি সেই চেষ্টাই করে চলেছি আমরা।


এই বৈপরীত্যের জগতে- জ্ঞান ও চেতনা লাভের ডাক -আত্মবিকাশ লাভের আহ্বান যেমন ভাগ্যের ঐচ্ছিক শক্তির দান, তেমনি আবার জ্ঞান ও সত্য লাভে অনিহা –আত্মবিকাশ লাভে অনিচ্ছাও দেখা দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে। যে ইচ্ছাক্রমে এই মহাজগৎ সৃষ্টি হয়েছিল, যে ইচ্ছাক্রমে ঈশ্বর এবং তার সৃষ্ট জীব- আমরা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আত্মবিকাশের পথে এগিয়ে চলেছি, সেই আদি-ইচ্ছা –আত্মবিকাশ বা মনোবিকাশের ইচ্ছা অন্তর্গ্রথিত হয়ে আছে আমাদের সবার অন্তরের গভীরে। যে সেই অন্তরের ডাক শুনতে পায়, সেই ভাগ্যবান।

40 views0 comments
bottom of page