top of page
Maha yoga.jpg

'মহামনন' ধ‍্যান প্রশিক্ষণ ~মহর্ষি মহামানস

আত্মবিকাশ! আত্ম-চেতনার বিকাশ, আত্মশক্তি আত্ম-সম্পদ, আত্ম-জ্ঞানের বিকাশ! গভীর আত্ম-সাগরের নিস্তরঙ্গ শান্তির বিকাশ।

আত্ম সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ আত্মবিকাশের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তখন নানা কাজের ফাঁকে, মাঝে মাঝেই চলতে থাকে আত্মচিন্তন--- আত্মজিজ্ঞাসা--- আত্মানুসন্ধান--- আত্মবিশ্লেষণ প্রভৃতি। ক্রমশ আরো পথ পেরিয়ে, পরোক্ষ ও স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান লাভের মধ্য দিয়ে--- যথেষ্ট চেতনা বৃদ্ধি পেলে, বিকাশ লাভের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। সে তখন পথ এবং পথপ্রদর্শক খুঁজে ফেরে। কোন পথে, কি পদ্ধতিতে দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, কার কাছে গেলে পাওয়া যায় সঠিক পথ ও সহজ পদ্ধতির সন্ধান, প্রায়শই এই চিন্তায় মগ্ন থাকে সে তখন।

আপাতদৃষ্টিতে/প্রতীয়মান বাস্তবে সবকিছু থাকা সত্ত্বেও মনে শান্তি নেই, এরকম মানুষের সংখ্যা আজ ক্রমশই বেড়ে চলছে। অযথা--- অনিয়ন্ত্রিত চাহিদার কারণেও বহু মানুষ হতাশ ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে যারপরনাই অশান্তি ভোগ করছে।

'মহামনন' শিক্ষা ও অনুশীলনের দ্বারা সাময়িকভাবে লাভবান হবার পর, স্থায়ীভাবে লাভবান হবার জন্য এখানে শিক্ষা গ্রহণ অনুশীলনের পরেও নিজের নিজের আবাসস্থলে নিয়মিতভাবে বিধি-নিয়ম মেনে 'মহামনন' অনুশীলন করে যেতে হবে। প্রয়োজনে, বাড়ির অন‍্যান‍্য সদস্যদেরকে সঙ্গে নিয়েও প্রতিদিন 'মহামনন' অভ‍্যাস করলে, গৃহে শান্তি বজায় থাকবে।

আত্মবিকাশের সহায়ক যোগ পদ্ধতি গুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোগ হলো 'মহামনন' যোগ। ধ‍্যেয় এবং ধ‍্যানী সেখানে এক অভিন্ন। অর্থাৎ আত্ম-ধ্যান বা অধ‍্যাত্ম-ধ‍্যান। 'মহামনন' ধ‍্যান প্রচলিত কোনো ধর্মীয় ধ‍্যান নয়।

ধ্যান করতে গিয়ে অনেকেই সমস্যায় পড়ে। মনের বিশৃঙ্খলা অবস্থার কারণে, সফল হতে না পেরে, ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় অনেকেই। সরাসরি ধ্যানের গভীরে পৌঁছানো সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই ধানের প্রস্তুতির জন্য অনুসরণ ও অনুশীলন করতে হয় আরো কিছু সাধন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া গুলোও আত্মবিকাশের পক্ষে সহায়ক হয়ে থাকে। এর মধ্য দিয়ে জানতে হয় এবং উপলব্ধি করতে হয়--- মনের তথা চেতনার বিভিন্ন স্তরগুলিকে। এর মধ্য দিয়ে সেই সঙ্গে মানসিক এবং মনোদৈহিক সুস্থতাও লাভ হয় অনেকটাই।

তবে তার আগে জানতে হবে ধ্যান কী, ধ‍্যান কিভাবে ঘটে, তারপর ধ্যান কেন করবো, কিভাবে করবো। 'ধ্যান' অধ্যায়ে এ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। তবু বলি, সাধারণভাবে কোনো জাগতিক বা বহির্জাগতিক বিষয়বস্তুতে, অথবা ঐরূপ কোন বিষয়বস্তুর স্মৃতিতে--- একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করে, পুনঃ পুনঃ ওই একই বিষয়ে বা বস্তুর চিন্তনের মধ্য দিয়ে--- বিষয়বস্তুর মধ্যে নিহিত সত্য (রূপ---গুণ---শক্তি--- উপাদান প্রভৃতি তত্ত্ব ও তথ্য) উদঘাটন প্রক্রিয়াকেই অনেকে ধ‍্যান বলে থাকে।

মনকে শান্ত--- স্থির--- একাগ্র করার উদ্দেশ্যেও অনেকে অনুরূপ ধ‍্যান করে থাকে। জাগতিক বা বহির্জাগতিক কোনো কিছুকে মনে ধারণ করে, তাতে একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করাকে 'ধ‍্যান-ধারণা'-ও বলে অনেকে। আবার বস্তু নিরপেক্ষ ধ‍্যানও করে কেউ কেউ।

'মহামনন' যোগ অর্থাৎ আত্ম-ধ‍্যানের বিষয়--- ধ‍্যানী নিজেই। যাকে জানতে পারলে সব জানা হয়, যার মধ্যে বিকাশের অপেক্ষায় নিহিত আছে অতুল শক্তি--- মহাজ্ঞান--- মহাচেতনা, সেই 'আমি'--- অন্তরামি ও তার কেন্দ্রই হলো মহামনন ধ‍্যান-যোগের লক্ষ্য। আর শান্তি! সে তো মোহ-মায়ারূপ জাগতিক বিষয় বস্তু এবং তার প্রতি আকর্ষণ বশতঃ সৃষ্ট জাগতিক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে, আত্ম-সাগরের গভীরে ডুব দিলেই মিলবে অপরিমেয়--- অনাবিল শান্তি।

তবে, কে আত্ম-সাগরের কত গভীরে নামতে পারবে, কার কত দম-সামর্থ, কে কতটা রত্ন তুলে আনতে পারবে সেখানে থেকে, সাগর কাকে কতটা উজাড় করে দেবে তার ধন-সম্পদের ভাণ্ডার, তা নির্ভর করছে ধ‍্যানীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, এবং ধ‍্যানী কোন চেতন স্তরে অবস্থান করছে এবং তার আন্তরিক চাহিদার উপর। নির্ভর করছে পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং পরম্পরাগত ঘটনাপ্রবাহের উপর।

মনে রাখবে, এই জীবনেই সব পাওয়া সম্ভব নয়। তুমি যে চেতন স্তরে আছো, সেই চেতন-স্তরের চেতনা, চাহিদা, সামর্থ্য, চেষ্টা, পন্থা, কৌশল অনুশীলন, শারীরিক ও মানসিক গঠন, সুস্থতা এবং প্রাপ্ত পরিবেশ-পরিস্থিতি, সুযোগ-সুবিধা, বাধাবিঘ্ন প্রভৃতি সাপেক্ষে তোমার প্রাপ্তি ঘটবে।

অলীক-কল্পনা আকাশ-কুসুম-এর পিছনে ছুটে যেন হতাশায় ভুগতে না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। কথায় আছে, 'যার কান্ডজ্ঞান নেই--- সেই কিনা দিব্যজ্ঞান এর পিছনে ছুটে মরে।' ---তেমনটি যেন না হয়।

পায়ে পায়ে এগিয়ে--- অনেক কষ্টে, অনেক সময় নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়। একলাফে দেশ-কাল পেরিয়ে ম্যাজিকের মতো এই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

যোগ বা ধ‍্যানের মাধ্যমে অতি কিছু পাওয়ার ঝোঁক অনেকের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। এই ঝোঁক--- অন্ধ আবেগপূর্ণ অতি ঝোঁক হলেই সর্বনাশ। অতি কিছু পাওয়ার আশা নয়, নিজেকে ধীরে ধীরে ক্রমশ যতটা সম্ভব বিকশিত করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাও। সামর্থমতো যতটা সম্ভব নিজেকে সুস্থ-শান্ত, স্বনিয়ন্ত্রণাধীন করার লক্ষ্য নিয়েই ধ্যান করো। অতি কিছু লাভ হলে ভালো, না হলেও ক্ষতি নেই। এই মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গেলে, লাভ বৈ লোকসান হবে না।

ধ‍্যানের মূল লক্ষ্য হলো--- সত‍্য। সত্য উদঘাটন--- সত্যকে জানা, সত্যে পৌঁছানো, সত‍্যে স্থিত হওয়া। সত‍্যের জন্য আকুল হয়ে ধ্যান করো। একটু একটু করে সত্য তোমার কাছে প্রকাশ লাভ করবে। এটাই হলো সবচাইতে বড় পাওয়া।

আমাদের পরম বিষয় হলো 'আমি', যার মধ্যে নিহিত রয়েছে অতুল সম্পদ। চেতনার ক্রমবিকাশের হাত ধরে যা একদিন আমরা সবাই লাভ করবো।

দ্রুত বিকাশ-উন্মুখ যাঁঁরা তাঁঁদের বুকের মাঝে বেজে উঠেছে--- মহা আত্মবিকাশ আগমনীর ঢাকের কাঠি। এই জীবনেই যতটা সম্ভব দ্রুতগতিতে এগিয়ে, আরো বেশি আত্মবিকাশ ঘটিয়ে, লাভ করতে চায় আরও কিছু আত্ম-সম্পদ, লাভ করতে চায় অনাবিল শান্তি, তাদের জন্যেই মহামনন ধ‍্যান, আত্ম-ধ‍্যান এই মহান আত্মবিকাশ যোগ শিক্ষাক্রম।


'আমি'--- মহা চৈতন্য-সাগরের একটি বিন্দু বা একক। যাকে জানতে পারলে--- সব জানা হয়, যাকে পেলে--- বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বরকে পাওয়া হয়, যাতে বিলীন হলে, ঈশ্বরে বিলীন হয়ে যায়--- ক্রমে ঈশ্বর হয়ে যায় মানুষ।

এই 'আমি' কিন্তু শুধু আজকের আমি নয়। এখানে সর্বোচ্চ চেতন 'আমি' সহ সমগ্র আমির কথা বলা হয়েছে। 'সব পাওয়া হবে--- সব জানা হবে' সেই সর্বোচ্চ চেতন 'আমি'-র বিকাশ ঘটলে, বা সেই আমিত্ব লাভ করলে, তার আগে নয়।

এই জীবনেই কি সর্বোচ্চ মনের বিকাশ ঘটানো সম্ভব? ---না, কখনোই--- কারো পক্ষেই সম্ভব নয় (দ্রষ্টব্যঃ 'নিজের মনকে জানো')। বর্তমান সচেতন-মন আত্ম-বিকাশ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বড়জোর নিজের, অর্থাৎ মানব-চেতন মনের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম, এই জীবনে। আর নিজের যথেষ্ট বিকাশের সাথে সাথে স্বভাবতই ---পরবর্তী উচ্চ চেতন মনের আংশিক বিকাশ ঘটতে পারে। ---এর বেশি নয়। এ-ই অনেক পাওয়া, এর বেশি আশা করা মুর্খামি।

এখন, যানতে হবে, এই 'আমি' -টা কে। এই দেহটা যে আমি নয়, আশাকরি এই বোধটা তোমাদের আছে যা হয়েছে। তাহলে মনটাই কি 'আমি'! মনের দিকে তাকালে (অন্তরে দৃষ্টিপাত করলে বা অনতরানুভব করার জন্য তার প্রতি মনোসংযোগ করলে) বোধ হবে, --- না, মনটাও 'আমি' নয়। যার দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়, সে তো বাইরের জিনিস, ---সে 'আমি' হয় কি করে! যেখানে থেকে মনের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করছি, 'আমি'-টা আছে সেই খানে।

আপাতদৃষ্টিতে এরকম মনে হলেও, প্রকৃত সত্য তা' নয়। মন-ও একটা 'আমি', ---পূর্বের 'আমি'। ---অনেকাংশে বর্তমানের 'আমি'। আর, সচেতনভাবে এখন যাকে 'আমি' বলছি, ---সে হলো আগামীর 'আমি' এবং আংশিকভাবে বর্তমানের 'আমি'।

ব্যাপারটা খুবই দুর্বোধ্য ঠেকছে, তাই না! আসলে সমগ্র মন অনেকগুলি স্তরে বিভক্ত। পেঁয়াজের মতো বা পদ্মের মতো, ভিন্ন ভিন্ন রূপে--- স্তরে স্তরে সাজানো। যেমন শিশু-মধ, কিশোর-মন, যুবক-মন প্রভৃতি (মন সম্পর্কে স্বতন্ত্র রচনা দেখো)। এইভাবে ক্রমশ একের পর এক স্তর বিকশিত বা প্রস্ফুটিত হতে হতে, শেষে পূর্ণ মনোবিকাশ বা আত্মবিকাশ! তারপর আর মন নেই, 'আমি' নেই। থাকে শুধু বীজ। সমস্ত পাঁঁপড়ি ঝরে গিয়ে--- মনোপদ্মের বীজ অবশিষ্ট থাকে। যা আসলে পুনরায় আত্মবিকাশ লীলার গোপন প্রস্তুতি (মহর্ষি মহামানসের অধ‍্যাত্ম মনোবিজ্ঞান হতে গৃহীত সারসংক্ষেপ)।

এখন, ধ‍্যানের বিষয় যে--- 'আমি', সে হলো বর্তমানে আংশিক বিকশিত--- ক্রমবিকাশমান কিশোর মন বা সচেতন মন, যে পরবর্তীকালে পূর্ণ বিকাশলাভের অপেক্ষায়। আর, এখন যাকে 'মন' বলছি, সে হচ্ছে অনেকাংশে বিকশিত, অথবা কারো কারো ক্ষেত্রে প্রায় বিকশিত শিশুমন বা অবচেতন মন।

আমাদের এই 'মন' বা শিশুমন এখন অনেকটাই বিকশিত। তাকে নিয়ে আমাদের চিন্তা থাকলেও, তার বিকাশ আমাদের লক্ষ্য নয়। বিকাশের লক্ষ্যে রয়েছে এখন কিশোর-মন বা সচেতন মন। যাকে বলা হচ্ছে 'আমি' ---সচেতন 'আমি'। অতি নিম্ন চেতন-স্তরের মন থেকে শিশুমন পর্যন্ত, নিম্নচেতন মনগুলি--- নিজেরা নিজেদের বিকাশ ঘটাতে অক্ষম। শিশুমনের বিকাশ ঘটে অতি ধীর গতিতে কর্ম ও ভোগের মধ্য দিয়ে, বহু দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা, বহু পীড়নের মধ্য দিয়ে তিলে তিলে।

এখানে, আমি মনকে দেখছি বা অনুভব করছি, অর্থাৎ কিশোর-মন (সচেতন মধ) শিশুমনকে (অবচেতন মনকে) দেখছে বা অনুভব করছে, অথবা তার ক্রিয়া-কলাপ পর্যবেক্ষণ করছে। এখানে কিন্তু প্রত্যেকের নিজস্ব সত্তা বা অস্তিত্ব রয়েছে। যেন, পদ্মের এক সারি বা এক স্তরের পাঁপড়ি তার নিচের সারির পাঁঁপড়িকে দেখছে ('মন-আমি যোগ' অনুশীলন করলে বুঝতে পারবেন)।

বর্তমানে আমাদের মনোরাজ্যে দুটি মন সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। একটি হলো--- শিশুমন বা আদিম বা প্রাক মানব-চেতন মন, আর অপরটি হলো--- কিশোর-মন বা মানব-চেতন মন। প্রচলিত ভাষায়, প্রথমটিকে বলা হয়--- অবচেতন মন। আর দ্বিতীয়টিকে বলা হয় সচেতন মন।

কোন শিক্ষক বা গুরুর দ্বারা অথবা অন্য কোন মাধ্যমের দ্বারা, দুটি মনের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সম্পর্কে উপলব্ধি না হওয়া পর্যন্ত, সাধারণত সবার বোধহয়--- যেন আমাদের একটাই মন। একটা মনই কখনো 'হ‍্যাঁ', আবার কখনো 'না' বলছে। কখনো সে আবেগ ধর্মী, আবার কখনো সে বিবেক ধর্মী। এইরকম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন 'মুডে' কাজ করছে। কখনো আবার ক্ষণিকের মধ্যেই বিপরীত ধর্মী আচরণ করছে। নিজেই অন‍্যায় করছে, আবার নিজেই শাসন করছে। এইরকম অভিজ্ঞতা সবারই কমবেশি আছে। দুটি মনের আলাদা অস্তিত্ব--- সম‍্যক উপলব্ধি করার পর, তখন ব‍্যক্তির দৃষ্টি বদলে যায়। তখন সে যেন এক অন্য মানুষ! নতুন চেতনার আলোকে দেখতে শুরু করে সে তখন।

তখন, দুটি মন সরাসরি পরস্পরকে দেখতে না পেলেও, একে অপরের অস্তিত্ব সম্পর্কে কমবেশি ওয়াকিবহাল। শিশুমনের চেতনার ন‍্যুনতার কারণে, সে কিশোর-মনকে ভালোভাবে জানতে-- বুঝতে অক্ষম হলেও, এবং মাঝে মাঝেই কিশোর-মনের কথা বিস্মৃত হলেও, সে এইটুকু জানে, যে তার উপরে একজন বড় কর্তা আছে। ---যাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মান্য করে চলতে হয়।

এদিকে, এখনও পর্যন্ত কিশোর-মনের (সচেতন মনের) যথেষ্ট বিকাশ না ঘটার ফলে, সে নিজের পূর্ণ ভূমিকা পালনে সব সময় সমর্থ না হলেও, শিশুমনের (অবচেতন মনের) কাজকর্মের উপর নজর রাখা, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা, এবং সেইসঙ্গে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করার যথাসাধ্য চেষ্টা সে করে থাকে--- তার সামর্থ মতো। এককথায়, মনের রঙ্গমঞ্চে শিশুমনের প্রায় একক নাট‍্যাভিনয়ে--- সে (সচেতন মন) কখনো নেপথ্যে থেকে প্রম্পটারের ভূমিকা, আবার কখনো মঞ্চে আবির্ভূত হয়ে বিবেকের ভূমিকা পালন করে থাকে। বেশিরভাগ সময় সে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে--- যথেষ্ট বিকাশের অভাবে।

কোন 'মন' তার ক্রমোচ্চ পরবর্তী বিকাশযোগ্য অপেক্ষাকৃত উচ্চ চেতন মনের ভিতরকার ক্রিয়া-কলাপ অনুভব করতে অক্ষম। তাকে সম্যক উপলব্ধি করতে অক্ষম। শুধু তদ-উচ্চ মনের বিকাশের পরিমাণ অনুসারে, তার শক্তি-- প্রভাব-- নির্দেশ মান্য করতে এবং তার প্রচ্ছন্ন অস্তিত্ব অনুভব করতে সক্ষম। কোনো মনের যথেষ্ট বিকাশ বা পূর্ণবিকাশ--- তার উর্দ্ধতন তদপেক্ষা উচ্চ চেতন মনের বিকাশের উপরেও নির্ভরশীল। সেই উচ্চ চেতনার প্রভাবে সে আরও সমৃদ্ধ হয়ে পূর্ণতা লাভ সক্ষম হয়।

প্রকৃত (যুক্তিসঙ্গত) জ্ঞানযোগের পাঠ সহ 'সুষুপ্তি যোগ' এবং 'মন-আমি যোগ' অনুশীলনের মধ্য দিয়েই দুটি মনের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অনুভূত হয়ে থাকে। তবে শুধু উচ্চ চেতনাসম্পন্ন আত্মসচেতন ব্যক্তিগণই নিজেদের মনোরাজ্যে দুটি মনের অস্তিত্ব এবং তাদের কর্মকান্ড অনুভব করতে সক্ষম। অপেক্ষাকৃত নিম্ন-চেতনার মানুষের ক্ষেত্রে, মনোরাজ‍্যের এই সমস্ত লীলা খেলা তাদের অজ্ঞাতেই ঘটে থাকে। তাদেরকে চিনিয়ে দিলেও তারা চিনতে পারে না। অথবা তখনকার মতো চিনতে পারলেও, পরে তা' ভুলে যায়। মনে রেখো, এই উচ্চচেতনা ও নিম্নচেতনা--- ব্যক্তির সচেতন মনের বিকাশের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল।

'আমি' (সচেতন মন) আমাদের ধ‍্যানের বিষয় হলেও, প্রথমে 'মন'-কে (অবচেতন মনকে) জানতে হবে, নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হবে। তাকে সুস্থ ও দূষণ মুক্ত করতে হবে। অসুস্থ-- অস্থির-- বিক্ষিপ্ত মনই ধ‍্যানের প্রধান অন্তরায়। তাই, তাকে এড়িয়ে নয়, তাকে অবদমন করে নয়, তাকে জয় করে--- তার সাহায্য নিয়ে, তবেই স্ব-বোধে--- 'আমি'-র কেন্দ্রে পৌঁছানো সম্ভব হবে। 'আমি' -র ধ‍্যানে, অন্যান্য বিষয়বস্তুর ধ‍্যানের মতো, সরাসরি 'আমি'-র কেন্দ্রে একাগ্র হওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে, অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে। পরে ধ‍্যান প্রক্রিয়ায় তা আলোচনা করছি।

মনকে না জেনে, তাকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ন্ত্রণ না করে, বরং মনের পাগলামী কে প্রশ্রয় দিয়ে, অবাস্তব কাল্পনিক বিষয়ের ধ্যান করলে, মন সে চাহিদা মেটাতে-- কল্পনার জাল বুনে, রঙিন স্বপ্নের অবতারণা করবে। 'ইলিউশন' 'হ‍্যালুউসিনেশন' সৃষ্টি করবে। আর, তাতেই যদি তুমি ভাবো--- সব পেয়ে গেছি! ---অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেছি! তাহলে তা' হবে নির্বোধের স্বর্গবাস করার মতো ঘটনা।

'মহামনন ধ‍্যান' বা আত্ম-ধ‍্যানের সঙ্গে সাধারণ ধ‍্যান এবং সম্মোহন নিদ্রার মধ্যে পার্থক্য হলো, 'মহামনন ধ‍্যান' বা আত্ম-ধ‍্যানে, আবেগপ্রবণ ও কল্পনাপ্রবণ শিশুমন (অবচেতন মন) সচেতন মনের সজাগ দৃষ্টির সামনে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকার ফলে, সে বিবশ হয়ে-- অভিভূত হয়ে বিশ্রাম অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে থাকে। আর কিশোর-মন বা সচেতন-মন থাকে জাগ্রত অবস্থায়। অবশেষে নিজেকে নিজের মধ্যে পেয়ে, এক অব‍্যক্ত আনন্দে কাটিয়ে দেয় সে বেশ কিছু সময়।

সাধারণ ধ‍্যান এবং সম্মোহন নিদ্রায় তার বিপরীত ঘটে। সেক্ষেত্রে, কিশোর মন বা সচেতন-মন বিশ্রামাবস্থা প্রাপ্ত হয়, আর কল্পনাপ্রবণ শিশুমন (অবচেতন মন) কিছু অংশে অভিভূত হলেও, অনেকাংশে সজাগ থাকে। এক্ষেত্রে তারই প্রধান ভূমিকা থাকে।

'মহামনন' আত্ম-ধ্যান এবং সম্মোহন-নিদ্রা বা নিদ্রাযোগ এই দুটি ক্ষেত্রে আমাদের দুটি মনের পৃথক পৃথক ভূমিকা রয়েছে। দুটি মনকেই আমাদের প্রয়োজন এবং এদের দু'জনকেই জানতে হবে। কিশোর-মন বা সচেতন মনকে নিদ্রাযোগ বা সম্মোহন পদ্ধতিতে সহজেই ঘুম পাড়ানো যায়, কারণ সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এই মনটি স্বল্পাংশে জাগ্রত এবং তেমন সক্রিয় নয়। তার তন্দ্রাচ্ছন্নতা এখনো কাটেনি। কিছু মানুষকে দেখা যায়, জাগ্রত অবস্থায় কথা বলতে বলতে অথবা কাজ করতে করতে, এদের ঘুমের ঢুলুনি এসে যায়। এই সচেতন মনটির অবস্থাও ঠিক তেমনই। আপাতদৃষ্টিতে জাগ্রত ও কর্ম ব্যস্ত মানুষের সচেতন-মন সারা দিনে-রাতে কতবার যে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে, আবার চট্ করে জেগে ওঠে তার কোন হিসেব নেই। সচেতন মনের অনুপস্থিতির সুযোগে, শিশুমন বা অবচেতন মনের লীলাখেলা বা কল্পনা চলতে থাকে অবাধে।

কোনো বিষয়বস্তুতে কিছুক্ষণ স্থির-একাগ্র হয়ে থাকলেও, কিশোর-মন বা সচেতন-মন অবশতা প্রাপ্ত হয়ে তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়ে। ভিতরে উত্তেজনা না থাকলে এবং সামনে উত্তেজক কিছু না থাকলে, শান্ত পরিবেশে তন্দ্রাচ্ছন্নতা আসে আরও তাড়াতাড়ি। এ অবস্থায় নিদ্রার সংস্কার (প্রি-প্রোগ্রামিং সাজেশন) থাকলে তো আর কথাই নেই। শীঘ্রই ঘুমের কোলে নিজেকে সঁপে দেব সে। আত্ম-ধ‍্যানের সময়ও এরকম ঘটতে পারে। তবে সতর্ক--সচেতন ও জাগরণের জোরালো সংস্কার (প্রি-প্রোগ্রামিং) থাকলে, সে আর ঘুমিয়ে পড়বে না। আত্ম-ধ‍্যানের সময় শিশু-মন বা অবচেতন-মন --- কিশোর মনের (সচেতন মনের) সতর্ক দৃষ্টির সামনে ক্রমশ উত্তেজনা হারিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

বিভিন্ন প্রয়োজনে--- অপ্রয়োজনে আমরা প্রায় অহরহ ধ‍্যান করছি। কখনো সচেতনভাবে--- জ্ঞাতে, কখনো অজ্ঞাতে। কখনো ক্ষণকালের জন্য কখনো অল্প সময়ের জন্য। অধিকাংশ সময়েই এই সমস্ত ধ্যান গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী না হলেও, ধ‍্যান আমাদের স্বভাব গুণ। কিন্তু অনেক সময়েই আমরা নিজেদের অনেক গুণ--ধর্ম-- ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন নই, তাই প্রয়োজন হয় এ বিষয়ে দক্ষ-- অভিজ্ঞ একজন গুরুকে, যিনি পথ দেখিয়ে দেবেন প্রক্রিয়া শিখিয়ে দেবেন। এছাড়া সাধারণভাবে যে কাজ করতে বহু সময়--- বহু শ্রম ব্যয় হয়, সেই কাজই অল্প সময়ের মধ্যে অনায়াসে সম্পন্ন হতে পারে একজন উচ্চশ্রেণীর গুরু বা পথপ্রদর্শকের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও সহজ পন্থা বা পদ্ধতি অবলম্বন করে।

ধ্যান আমাদের মনের স্বভাব গুণ হলেও, চঞ্চলতাও তার স্বভাব ধর্ম। বিশেষত শিশুমন বা অবচেতন মনের স্বভাবই হলো চঞ্চলতা। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ছোটাছুটি করাই তার স্বভাব। আবার, তার সঙ্গে যদি থাকে অসুস্থতা, তাহলে তো আর কথাই নেই। শিশুমন বা অবচেতন মনের কাছে অত্যন্ত কোন বিষয়বস্তু অত্যন্ত আকর্ষণীয় না হলে, সে সেই বিষয়বস্তু থেকে দ্রুত সরে যাবে অন্য বিষয়বস্তুতে। আবার, সে যদি কখনো কোনো বিষয়বস্তুতে খুব আকর্ষণ বোধ করে, সেক্ষেত্রে সে মোহিত হয়ে--- মোহ-আবেশে আবিষ্ট হয়ে, সেই বিষয় বস্তুর প্রতি স্থির একাগ্র হয়ে--- ধ‍্যানস্থ হয়ে পড়ে তখন।

এই বৈপরীত্য সম্পন্ন মনটাকে ভালোভাবে জেনে, তাকে সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের আত্মবিকাশের পথে। আমাদের সচেতন-মনের বিষয়বস্তু যে সব সময় এই শিশুমনের (অবচেতন মনের) কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হবে, এমন নয়। তাই আমাদেরকে কিছু বিশেষ উপায়--- বিশেষ কিছু যোগ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাকে বশে আনতে হবে, সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে।

বিশেষ করে, অদেখা-- অজানা অন্তর-বিষয়ের ধ‍্যানের মতো এক কঠিন বিষয়ের ক্ষেত্রে, প্রথমদিকে আমরা অনেকেই অসহায় বোধ করে থাকি। যার জন্য প্রয়োজন হয় এমন একজন সদগুরু-কে যিনি প্রকৃতই জানেন, যিনি হাতে-কলমে শিখিয়ে দেবেন, সংশয়ের দুয়ার পার হতে--- যিনি ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেবেন--- সাহস জোগাবেন।

তত্ত্ব বিষয়ক অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, চেতনার ক্রমবিকাশের মধ্যদিয়ে ধাপে ধাপে পূর্ণ চেতনায় পৌঁছাতে হবে আমাদের। আমরা সবাই এক পথের পথিক, বিকাশমান চেতনার পথে। অস্ফুট চেতনা থেকে পূর্ণ চেতনার লক্ষ্যে, ক্রমবিকাশের পথ ধরে আমরা এগিয়ে চলেছি।

আমরা এখন যেখানে অবস্থান করছি, এ হলো--- মানব-চেতন-স্তর। এখান থেকে সামনে ঊর্ধ্বে--- বহু দূর পর্যন্ত দেখতে সক্ষম হলে, বুঝতে পারবে, আমাদেরকে এই মানব-চেতন-স্তর পেরোতে হবে প্রথমে। তারপর রয়েছে--- মহামানব চেতন-স্তর। তারপরে দেব-চেতন-স্তর। তারপরে ঈশ্বর চেতন-স্তরে পৌঁছে, ঘটবে ঈশ্বরত্ব লাভ। পূর্ণ মানবত্ব লাভ না করে, দেবত্ব বা ঈশ্বরত্ব লাভ সম্ভব নয়। এড়িয়ে বা ডিঙিয়ে যাওয়া যাবে না। পায়ে পায়ে সমস্ত পথ অতিক্রম করতে হবে। তবে যদি দ্রুত গতিতে পার হতে চাও, তাহলে 'মহামনন' ধ‍্যান এবং মহা আত্মবিকাশ যোগ-এর সাহায্য নাও।

ধ‍্যান কিভাবে করবো। সবচাইতে সহজ কাজটাই সবচাইতে বেশি কঠিন। ধ‍্যানের ক্ষেত্রে এই কথাটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। তা' সেই কঠিন কাজটিতে সাফল্য লাভ করতে প্রস্তুতি দরকার। প্রথমে নিজের মনকে চিনতে--- জানতে হবে। আমরা এখন যে চেতন স্তরে রয়েছি, সেখানে দুটি মন কাজ করছে। একটি হলো শিশুমন বা আদিম মানবচেতন মন বা অবচেতন মন। অপ‍রটি হলো--- কিশোর-চেতন মন বা মানবচেতন মন বা সচেতন মন। অস্থির-- অন্ধ-আবেগ পূর্ণ এই শিশু মনটাকে নিয়েই যত সমস্যা। এই শিশুমনটাকে 'প্রোগ্রামিং' -এর মাধ্যমে, সচেতন মনের নিয়ন্ত্রণাধীন করতে হবে। মনের মধ্যে জমে থাকা রাশি রাশি অবদমিত দুঃখ-কষ্ট-- অপমান-- লজ্জা-- গ্লানি-- কালিমা-কলুষ প্রভৃতি থেকে মুক্ত করে, তাকে নির্মল করে তুলতে, এবার এক পা-- এক পা ক'রে এগিয়ে যেতে হবে গভীর ধ‍্যানের লক্ষ্যে।

প্রথম পদক্ষেপ---
১৫ থেকে ৩০ দিন 'সুষুপ্তি যোগ' বা 'রিলাক্সেশন' অভ্যাস করতে হবে ধ‍্যান-যোগ -এ সফল হতে হলে যথেষ্ট রিল্যাক্সেবিলিটি বা শিথিল হওয়ার ক্ষমতা থাকা দরকার। ভালো রিল‍্যাক্সড্ হতে পারলে তবেই প্রত্যাশামতো উন্নতি হবে এবং সাফল্য পাওয়া যাবে। ক্লাসে 'সুষুপ্তি যোগ' শেখানো হবে এছাড়া ওয়েবসাইটে সুষুপ্তি যোগ -এর উপর রচনা পড়ুন। এর পাশাপাশি প্রাণযোগ অভ‍্যাস করতে হবে প্রতিদিন। প্রাণযোগ ক্লাসে শেখানো হবে। এছাড়া, ওয়েবসাইটে প্রাণযোগের উপর রচনা পড়ুন।

দ্বিতীয় পদক্ষেপ---
১৫ দিন 'মন-আমি যোগ' অভ্যাস করতে হবে। ক্লাসে 'মন-আমি যোগ' শেখানো হবে। এর পাশাপাশি প্রাণযোগ অভ‍্যাস করুন।

**এখানে একটা কথা বলা আবশ্যক, প্রচলিত যোগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমাদের যোগ প্রক্রিয়াগুলির কিছু পার্থক্য রয়েছে। আমাদের এই যোগ প্রক্রিয়াগুলি অধ‍্যাত্ম-বিজ্ঞান ও অধ‍্যাত্ম-মনোবিজ্ঞান সহ আধুনিক মনোবিজ্ঞানের সমন্বয়ে গঠিত, সময়োপযোগী এক বিশেষ যোগ প্রক্রিয়া। যা সর্বসাধারণের উপযোগী অত্যন্ত ফলপ্রদ যোগ প্রক্রিয়া।

তৃতীয় পদক্ষেপ---
সুষুপ্তি যোগ, মন-আমি যোগ এবং প্রাণযোগ অভ্যাস করার পর, এবার ধানের জন্য বসতে হবে। এরমধ্যেও কিছু প্রক্রিয়া আছে যা ধ্যান নয়, ধ্যানের এর প্রস্তুতি বিশেষ। প্রথমে হাত-পা, চোখ-মুখ, ঘাড়-গলা ধুয়ে নাও, অথবা স্নান করেও নিতে পারো। নির্দিষ্ট স্থানে--- যেখানে কোনো বাঁধাবিঘ্ন প্রতিকূলতা নেই, কোন দূষণ নেই, এমন একটি সুন্দর স্থানে--- ধ‍্যানের জন্য নির্দিষ্ট আরামদায়ক আসনে বসতে হবে তোমাকে। এই সময় কেউ যাতে তোমাকে বিরক্ত না করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়জনে মশারী নেওয়া যেতে পারে। এসময় কোথাও যাওয়া বা কোন কাজের তাড়া থাকলে চলবে না।

প্রথম পর্ব---
৫  মিনিট প্রাণযোগ অভ্যাস করো।

দ্বিতীয় পর্ব---
সঙ্গীত যোগ।  সঙ্গীত শেষে, স্ব-বোধ -এ স্থিত হয়ে বিশ্রামে থাকো ২--৩ মিনিট।

তৃতীয় পর্ব---
ক্রন্দন যোগ। চোখ বুজে বা তাকিয়ে, শিথিল হয়ে বসে প্রায় ১০ মিনিট কাঁদতে থাকো। পাওয়ার জন্য কাঁদো। না পাওয়ার বেদনায় কাঁদো। দুঃখ-কষ্ট লজ্জা-অপমান;যন্ত্রণা ---যা তুমি না চেয়েও পেয়েছো, তার জন্য কাঁদো। অজ্ঞানতা-- চেতনাহীনতা--- অন্ধত্বের কারণে এতদিন যাবৎ অন্ধকার পাঁঁকে ঘুরপাক খেয়ে মরছো তুমি, তার জন্য কাঁদো। আলোর জন্য--- চেতনার জন্য--- মুক্তির জন্য কাঁদো। আকুল হয়ে কাঁদো। তোমার ভিতরে যে এত কান্না জমে আছে তুমি নিজেই জানো না। কেঁদে কেঁদে অন্তরের সমস্ত কালীমা-- কলুষ--- গ্লানি ধুয়ে মুছে দাও।


মনে রেখো, ধ্যানের প্রস্তুতি হিসেবে যা কিছু করছো--- তা' প্রায় সবই, মনের মধ্যে নানা বিষয় অবদমন করা থেকে সৃষ্ট-- পাষাণ দেওয়াল এবং আবর্জনাকে বহির্মুক্ত করার জন্য, মনকে নির্মল পবিত্র এবং খালি করার জন্য করছো। ক্রন্দন শেষে চোখ না খুলে শিথিল হয়ে, স্ব-বোধ -এ স্থিত হয়ে ২ মিনিট বিশ্রাম করো। এখন অন্তর চেতনা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে তোমার।

চতুর্থ পর্ব---

পূর্বের শিথিল অবস্থাতেই--- আরামদায়কভাবে, চোখ বুজে-- ভিতর ও বাহিরে সম্পূর্ণ মৌন হয়ে, স্ববোধ-এর চেতন -প্রদীপ জ্বেলে বসে থাকো। প্রথম দিকে 'মন-আমি-যোগ' -এর মতো কিছুক্ষণ মনের খেলা চলতে পারে, আবার নাও পারে। কারণ মন এতক্ষণে অনেক নির্মল-- প্রশান্ত এবং গ্লানি মুক্ত হয়ে উঠেছে। শিক্ষিত হয়ে উঠেছে। মন যা বলে, যা করে করুক, তুমি একটা কথাও (ভিতর ও বাহিরে) বলবে না।কোন কথা নয়--- ভাষা নয়। শুধু সজাগ-- সচেতন--- আত্মসচেতন হয়ে, আত্মবোধে স্থিত হয়ে, নিরাসক্ত--- নির্বিকার হয়ে, এক অব‍্যক্ত আনন্দ-- ভালোবাসা-- প্রেমে আপ্লুত হয়ে বসে থাকো।

কোন বিষয়েই আগ্রহী হবে না--- শব্দ-- আলো-- শূন্য-- মূর্তি-- যা-ই আসুক তোমার মনের সামনে, একেবারেই উৎসুক-- কৌতুহলী হবেনা। একাত্ম হয়ে পড়বে না কোন বিষয়ের সাথে।

ক্রমশ তোমার সমস্ত সত্তা স্বতস্ফূর্ত প্রেম--- ভালোবাসায় ভরে উঠবে। তুমি এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে উঠবে। স্ব-কেন্দ্রে পৌছাবার প্রতিটি ধাপে-- নানা অনুভূতি আসতে পারে, তুমি কোন কিছুর সঙ্গেই নিজেকে যুক্ত করবে না।

এক নির্মল মানস-সাগরে তুমি বিরাজ করছো। মনের খেলা অচিরেই বন্ধ হয়ে গেছে, অথবা শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে। তবে সতর্ক ও সজাগ থাকো, মন যেন কোনো ছুঁতোয়--- কোনো ছলনায় আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে না পারে।

....এখন, 'আমি' আছে, আমিত্ব আছে, কিন্তু এই 'আমি' সেই 'আমি' নয়। ---যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে এক বা একাধিক নাম, ঠিকানা, নানা অলঙ্কার, নানা বিশেষণ....। মনের (শিশু মনের) সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে ওসব ঝরাপাতার মতো ঝরে পড়ে গেছে। না, কোন বিচার নয়, কোন সিদ্ধান্ত নয়। স্ববোধে অবস্থান করো....।

এখন স্ববোধ আছে। কিন্তু স্বগৃহে-- স্বস্থানে--- আমির কেন্দ্রে পৌঁছাওনি এখনো। তোমার লক্ষ্য--- তোমার গন্তব্য ওটাই। তা'বলে চেতন কেন্দ্রমুখী হয়ো না। শিথিল---রিল‍্যাক্সড্ থাকো। কোন চাপ সৃষ্টি করো না। যেমন আছো--- তেমনি থাকো।

তোমার চেতন-সত্তা একটা বেলুনের মতো ফুলে ফেঁপে প্রসারিত হয়ে--- বহির্মুখী হয়ে আছে। বহির্জগতের রঙ-রূপ-রস প্রভৃতি উপভোগ করার জন্য--- সে নিজে কেন্দ্র থেকে বিস্তৃত হয়ে চতুর্দিকে উন্মুখ হয়ে ছড়িয়ে আছে। আছে চাপের মধ্যে। এবার সেই ফোলানো বেলুনটাকে যদি তার কেন্দ্রাভিমুখী চাপ দাও, তাহলে চাপ আরও বেড়ে যাবে। লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। এভাবে কোনোক্রমে অন্তরে গেলেও, সেখানে কিছু বা কাউকে পাবে না। সে বিক্ষিপ্ত থাকায়--- চাপগ্রস্ত এবং স্ফীত থাকায়, ওভাবে ঘরে ফেরা সম্ভব হবে না। অনেক সাধকের ক্ষেত্রেই এইরূপ ভ্রান্তি ঘটে। তাই যেমন আছো ---যেখানে আছো, চুপ করে নিঃশব্দে সজাগ হয়ে থাকো।

ক্রমশ 'আমি'-র পরিবর্তন ঘটছে। দেখো, আস্তে আস্তে আমিত্বের বেলুনটা একটু একটু করে চুপসে যাচ্ছে। ---শিথিল হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ ঘরমুখী হচ্ছে--- স্ব-কেন্দ্রমুখী হচ্ছে সে এবার।

এই ঘরে ফেরার বিভিন্ন স্তরে বা বিভিন্ন স্টেজে, বিভিন্ন রঙ-রূপ-রসের দৃশ্যাবলীর সাক্ষাৎ হতে পারে। তাদের কোনটির প্রতি যদি তুমি আগ্রহী হয়েছো, তো ঘরে ফেরার আশা ওখানেই শেষ। তাই প্রলুব্ধ না হয়ে, অধৈর্য্য না হয়ে, ছলনায় না ভুলে, শুধু দেখতে দেখতে ঘরে ফিরে চলো। চলো নিজ নিকেতনে। রেলগাড়ির জানালা পথে দৃশ্যাবলী দেখার মত--- সবই দেখছো, ভালোও লাগছে, কিন্তু মুল টান রয়েছে--- ঘর পানে। অন্য কোন কিছুতেই তেমন টান অনুভব করছো না।

চলো--- এভাবেই একটু একটু করে ডুবতে থাকো। ..... আস্তে আস্তে আমি-র বেলুনটা একটু একটু করে চুপসে যাচ্ছে। তুমিও ডুবে যাচ্ছো আমি-র অভ্যন্তরে। বহুদিন হলো নিজের ঘর বা কেন্দ্র ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছো। তাই ফিরতে একটু সময় তো লাগবেই। ধৈর্য হারালে ঘরে ফেরা হবে না। একটু ধৈর্য ধরো।....

এখানেই অনেক সাধক অসফল হয়ে ফিরে আসে। অথবা কোনো কিছুতে প্রলুব্ধ হয়ে--- অন্য স্টেশনে নেমে গিয়ে, অন্য কিছু দেখে বা নিয়ে ফিরে আসে। 

তোমার মধ্যে এই 'প্রি-প্রোগ্রাম' করে রাখা আছে, "তুমি ঘরে ফিরে যাচ্ছো, সেখান থেকে আত্ম-সম্পদ নিয়ে ফিরে এসে--- আরো ভালো ভাবে জীবনকে উপভোগ করবে। আরও বেশি বিকাশ লাভ করবে।" "আরো দ্রুতগতিতে চেতনা বিকাশের পথে এগিয়ে যাবার জন্য, রসদ সংগ্রহ করতে যাচ্ছ সেখানে। চেতন মনের বিকাশ ত্বরান্বিত করতে, তুমি ঘরে ফিরে যাচ্ছো।"

মনেরেখো, প্রথমে তোমাকে পূর্ণ বিকশিত মানুষ হতে হবে। তারপর তোমাকে দেবতা হতে হবে। তারপরে সর্বোচ্চ চেতনা লাভ হবে। এখন, তুমি অন্তরের জ্ঞান-গুণ-চেতনা, ঐশ্বর্য-ক্ষমতা-শক্তিতে শক্তিমান হয়ে ফিরে আসবে। যেমন ফিরে এসেছে সুষুপ্তি যোগ-এর ক্ষেত্রে। মাভৈঃ এগিয়ে যাও।

যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি কিছু দেখতে পাচ্ছো--- মনের কার্যকলাপ, কিংবা শূন্য বা জ্যোতি অথবা মূর্তি, অথবা 'আমি'-কে দেখতে পাচ্ছো, ততক্ষণ বুঝবে তোমার ঘরে ফেরা হয়নি। লক্ষ্যে পৌঁছাওনি।

'আমি' যতক্ষণ পর্যন্ত ফুলে-ফেঁপে থাকবে, ততক্ষণ 'আমি' এক অংশ থেকে আরেক অংশকে দেখলেও দেখতে পারে। 'আমি'-র বেলুন যখন চুপসে--- শিথিল হয়ে--- সংকুচিত হয়ে, স্ব-কেন্দ্রে ফিরে আসবে, তখনই 'আমি' প্রকৃত 'আমিত্বে' স্থিত হবে। তখন আর নিজেকে নিজে দেখতে পাবে না। শুধু অনুভব--- আত্মানুভব। আত্মানন্দ--- মহা আনন্দ অনুভব হবে তখন।

* প্রথম অবস্থায় 'মহামনন' ধ‍্যান অভ‍্যাস কালে, বেশি গভীরে না গিয়ে, ফিরে এসো ধীরে ধীরে একই পথ ধরে। প্রত‍্যেক সিটিং-এ একটু একটু করে ধ্যানের গভীরতা বৃদ্ধি পাক। যাওয়া--- আসা-- সহজ-- সাবলীল--- আয়ত্বাধীন হয়ে উঠুক। এইভাবে অভ‍্যাস করতে করতে কিছু দিনের মধ্যেই পৌঁছে যাবে তোমার লক্ষ্যে।

** প্রথমদিকে সাক্ষাৎ গুরুর সাহায্য প্রয়োজন। 

bottom of page