top of page
Search
  • Writer's pictureমহর্ষি মহামানস

নিজের মনকে জানো

‘মন’-এর কথা

(মহর্ষি মহামানস-এর অধ্যাত্ম-মনোবিজ্ঞান হতে গৃহীত)

একটি শিশুকে আগ্রহের সাথে বারবার নানাবিধ প্রশ্ন করতে দেখে, আমরা সাধারণতঃ তাকে উন্নতিশীল বা প্রগতিশীল শিশু বলে চিহ্নিত ক’রে থাকি। তার এইসব প্রশ্ন যদি নিছক কৌতুহল না হয়ে জানার আগ্রহ হয়, আর সে যদি তার স্বল্প জ্ঞান-অভিজ্ঞতা সম্বল ক’রেই যুক্তি-বিচার সম্ভাবনা-অনুমান-এর সাহায্যে সত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, এবং সেই পথে সত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়, তখন তাকে আমরা উৎকৃষ্ট শ্রেণীর শিশু বলে থাকি।


শুধু শিশুই নয়, বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রেও এ’কথা প্রযোজ্য। যে সচেতন মনটির মালিক হওয়ার সুবাদে— আমরা মানুষ বলে গণ্য হই, সেই সচেতন বা মানব-চেতন মনটি এখনো আমাদের অধিকাংশের মধ্যে শৈশব অবস্থাতেই রয়েছে। তার যথেষ্ট বিকাশ ঘটলে— তবেই ঘটবে মনোবিকাশ —ঘটবে মানব-বিকাশ।


সঠিক বিকাশের জন্য— জানার আগ্রহের সাথে থাকতে হবে সুস্থতা। ক্রোধ-উত্তেজনা-অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, অলসতা-উদাসীনতা প্রভৃতি অসুস্থতা জ্ঞাপক দোষসহ অন্ধ-বিশ্বাস, অন্ধবৎ অনুসরণ, নির্বোধের মতো সব মেনে নেওয়া, যুক্তি-বিচারের অক্ষমতা, এবং স্রোতে ভেসে চলার প্রবণতা প্রভৃতি দোষগুলি আমাদের বিকাশের পরিপন্থি। কষ্ট করতে রাজি নয়, এমন একজনের বক্তব্যঃ ‘বিশ্বাস করতে তো আর কষ্ট করতে হয়না, জ্ঞান অর্জনের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়!’ অথচ, জ্ঞানাভাবের কারণে তাকে আরো অনেক বেশি কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে!


মানব-জীবন লাভ ক’রে— মানব অস্তিত্ব সম্পন্ন উন্নত জীব হয়েও যদি কারো মধ্যে— নিজের সম্পর্কে—জীবন সম্পর্কে জোরালো প্রশ্ন না জাগে, আত্ম-জিজ্ঞাসা— জীবন-জিজ্ঞাসা —বিকাশাকাঙ্খা না জাগ্রত হয়, এবং যদি সে তার উত্তর সন্ধানে— সত্য সন্ধানে যুক্তিপথে অগ্রসর না হয়, সেক্ষেত্রে, তার সচেতন মনের অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়।


সচেতন বা মানব-চেতন মনের ধর্মই হলো— যুক্তি-বিচার-সতর্কতার সাথে বাস্তবপ্রিয়তা ও সত্যপ্রিয়তা প্রভৃতি। আর, অবচেতন বা প্রাক-মানব-চেতন মনের ধর্ম হলো— অন্ধ-আবেগ— অন্ধ-বিশ্বাস, অলীক কল্পনা প্রিয়তা প্রভৃতি। মনে রাখতে হবে, আত্ম-জিজ্ঞাসাই ঊর্ধগামী আত্ম-বিকাশ-পথের প্রথম সোপান। এবং আমাদের সতর্ক থাকতে হবে— তা’ যেন নিম্নগামী অন্ধবিশ্বাসের আপাত সুখকর পথে নেমে গিয়ে— পথভ্রষ্ট না হয়, —বিপথগামী না হয়।


আমাদের সচেতন-মন যত বেশি বিকশিত হবে, আমরা ততই অন্ধ-বিশ্বাস মুক্ত হয়ে— যুক্তি ও জ্ঞানপথে অগ্রসর হতে পারবো। আমরা যুক্তি ও জ্ঞানের পথ ধরে যত চলবো— সেইমতো সচেতন-মনের বিকাশও ঘটতে থাকবে ততই।

নিজের মনকে জানো

মন সম্পর্কে প্রচলিত ধারনায়, মনের দুটি বিভাগ বা অংশের মধ্যে একটি হলো--- হৃদয়, আর অপরটি হলো--- মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক বড় না হৃদয় বড়, এই নিয়ে অনেকের অনেক কথা শোনা যায়। কেউ কেউ বলেন, হৃদয়বান মানুষ মস্তিষ্কজাত বুদ্ধিমান মানুষ থেকে শ্রেয়।


এখন, আমরাও আমাদের (সক্রিয় ও নিস্ক্রিয় মিলে) সমগ্র মনের বর্তমানে সক্রিয় ভূমিকায় থাকা দুটি অংশ-মন সম্পর্কে জানি। তার একটি হলো---অবচেতন বা প্রাক-মানবচেতন মন, আর অপরটি হলো--- সচেতন বা মানবচেতন মন।


প্রথমটি হলো কল্পনা ও আবেগ প্রবণ--- যুক্তি-বুদ্ধি বিহীন অন্ধবিশ্বাসী, কাম-ক্রোধ-লোভ-লালসায় আসক্ত অবুঝ মন। প্রয়োজন বোধে এই মন তার চাহিদা পূরণের জন্য অপরাধ করতেও পিছু-পা নয়। এই মনের মধ্যে আবার রয়েছে, তার স্বজাতি---স্বধর্মী---স্বজনদের প্রতি সহজাত টান ও ভালোবাসা। এককথায়, মোহমায়ায় আচ্ছন্ন অজ্ঞান-অন্ধ এক দুর্রবার-দুরন্ত শিশু-মানব-মন।


এই মনটি এখন অধিক অংশেই বিকশিত ও সক্রিয়। অপর সচেতন মনের সঙ্গে একত্রে বাস করার ফলে, সচেতন মনের বিকাশের সাথে সাথে এই মনটিও এখন পূর্বের তুলনায় অনেকটাই পরিশীলিত। সচেতন মনের কিছু কিছু গুণ এর মধ্যে সংক্রামিত হওয়ায় সে এখন অনেকটাই আধুনিকা।


সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় এই মনটির সুমধুর রূপ আমরা প্রত‍্যক্ষ করেছি অনেকবার। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই বর্তমানে অসুস্থ হওয়ায়, এই মনও অসুস্থ--- বিকারগ্রস্ত।


দ্বিতীয় সক্রিয় মনটি হলো--- যুক্তি-বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন সজাগ-সচেতন মন। কিন্তু এই মনটি অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই খুব সামান্য মাত্রায় বিকশিত ও সক্রিয়। তাই, এখনো এর কার্যকলাপ খুবই অল্প ও সীমিত।


চোখে ঠুলি পড়ানো তীব্র বেগবান বুনো ঘোড়াসম অবচেতন মনের রাশ বা লাগাম ধরা রয়েছে এই মনের কাছে। তাকে নিয়ন্ত্রণ ক'রে ভালোভাবে জীবন যাপন করা এবং বিকাশ লাভ করাই হলো এই সত্যপ্রিয় জ্ঞানপ্রিয় সচেতন মনের ধর্ম-কর্ম।


এখন, হৃদয় বলতে আমরা এই অবচেতন মনকেই বুঝে থাকি। অনিয়ন্ত্রিত হৃদয়াবেগ-ই হলো অবচেতন মনের ধর্ম। সে সচেতন মনের নিয়ন্ত্রণাধীন না থাকলে, অন্ধ-আবেগ বশতঃ কখন যে কী করে বসবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।


সে নিজে অন্ধ-বিশ্বাসী হলেও, তাকে মোটেও বিশ্বাস নেই। সে যাকে ও যাদেরকে স্বজন--- সমগোত্রীয়--- সমভাবাপন্ন মনে করবে, তাকে ও তাদেরকে সে প্রাণ দিয়েও সমর্থন করে যাবে। বাকিদের প্রতি সে বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। তাদের বিনাশই তার কাম‍্য।


এই আদিমভাব সম্পন্ন মনটিকেই যারা একমাত্র পছন্দ ক'রে থাকে, তাদের মনও সমানুরূপ আদিম অবস্থায় রয়েছে। তাদের সচেতন মনের যথেষ্ট বিকাশ ঘটেনি এখনও। চারিপাশে একটু পর্যবেক্ষণ করলেই এমন মানুষ বহু দেখতে পাওয়া যাবে।

মন-আমি

(মহর্ষি মহামানস-এর অধ্যাত্ম-মনোবিজ্ঞান হতে গৃহীত)

মানব ধর্ম— ‘মহাধর্ম’ এবং মহাধর্মের অনুশীলনীয় পর্ব ‘মহামনন’ —আত্ম- বিকাশ বা মনোবিকাশ কার্যক্রমকে ভালোভাবে বুঝতে হলে, আমাদের ‘মন’ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকা আবশ্যক। ‘মন’ হলো— অনেকাংশে কম্পিউটার সফটওয়ারের মতো প্রায় বর্ণনাতীত –সাধারণের পক্ষে প্রায় বোধাতীত এক অতি সুক্ষ্ম অস্তিত্ব। মন-সফটওয়ার ও শরীর (হার্ডওয়ার), —এদের মাঝে একটি প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার বা ভিত্তিমন সফটওয়ার আছে। এই প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার-এর মাধ্যমেই শরীর যন্ত্রের যাবতীয় অনৈচ্ছিক ক্রিয়াকলাপাদি তথা সহজ-প্রবৃত্তিজাত কার্যাদি সংঘটিত হয়ে থাকে।


শরীরকে ভিত্তি করেই এই জৈব সফটওয়ার তৈরী হয়েছে। আর, শরীরসহ এই প্রাথমিক জৈব সফটওয়ারের ভিত্তিতেই তৈরী হয়েছে— মন-সফটওয়ার।


প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার বা ভিত্তিমন সফটওয়ার এবং মন-সফটওয়ার, — উভয়েরই স্বতন্ত্র অবয়ব আছে। এই অবয়ব আমাদের বর্তমান চেতন-স্তরে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। উচ্চতর চেতনস্তরের মন এই অবয়ব উপলব্ধি করতে সক্ষম। অন্যান্য সমস্ত অস্তিত্বশীলদের মতই উভয় সফটওয়ারেরই আছে অশরীরী দিব্য অস্তিত্ব (দ্রষ্টব্যঃ Super-existence)। একেই অনেকে আত্মা বলে থাকেন। কিন্তু, সমগ্র মন-অস্তিত্বই হলো— আত্মা। সে দেহযুক্তই হোক আর দেহাতীতই হোক (দ্রষ্টব্যঃ আত্মা)।


প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার এবং মন-সফটওয়ার— উভয়েরই নিজস্ব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকলেও, কেউই পুরোপুরি স্বাধীন নয়। একে অপরের উপর, এবং শরীরসহ বহীর্জাগতিক বিষয়-বস্তুর উপর উভয় জৈব সফটওয়ারই কম-বেশি নির্ভরশীল। আবার, শরীরসহ বহীর্জাগতিক বিষয়-বস্তুর উপরেও এরা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। মানসিক কার্যকলাপ এবং শারীরীক কার্যকলাপ (যা প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার দ্বারা পরিচালিত অনৈচ্ছিক ক্রিয়াকলাপ) একে অপরের উপর প্রভাব বিস্তার ক’রে পরস্পর সহযোগী হয়ে কাজ ক’রে থাকে। এর পিছনে রয়েছে— জগতব্যাপী পরম্পরাগত অজস্র কার্য-কারণ স্বরূপ অসংখ্য ঘটনার সম্মিলিত ঘটনাপ্রবাহ। শরীর ও মনের ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক ক্রিয়া-কান্ডগুলি হলো— জগতব্যাপী পরম্পরাগত অজস্র ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে প্রসুত ফল, এবং সেই সম্মিলিত ঘটনা প্রবাহেরই অংশ, যা আরো অনেক ঘটনার জন্মদাতা (দ্রষ্টব্যঃ ভাগ্য)।


ক্রমবিকাশমান পদ্মের মতই, সমগ্র মন— একের পর এক ক্রমোচ্চ স্তরে ক্রমশ বিকশিত হয়ে থাকে। বিকাশের প্রতিটি চেতন-স্তরে মনের এক এক প্রকার রূপ—গঠণ—কার্যকলাপ। অস্ফূট-চেতন-স্তর থেকে পূর্ণ-চেতন-স্তর অভিমুখে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে তুচ্ছ লক্ষ্য থেকে উচ্চ লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলা (এ’নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে ‘মহাবাদ’ গ্রন্থে)।


তবে, শরীর থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে অথবা স্বয়ংসম্ভুত হয়ে— মনের সৃষ্টি হয়নি। কম্পিউটার সফটওয়ারের মতো— মন-সফটওয়ারেরও স্রষ্টা আছে। প্রোগ্রামার— ডেভলপার আছে। প্রাথমিক জৈব সফটওয়ারসহ মন-সফটওয়ার এবং শরীরযন্ত্র তৈরী হয়েছে— ঈশ্বর দ্বারা, —ঈশ্বরের মন ও শরীর উপাদান থেকে। এই মহা বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডরূপ শরীর আর মহা বিশ্ব-মন নিয়েই হলো— ঈশ্বর অস্তিত্ব।


চেতনা হলো— শরীর ও মনের অনুভব—সংবেদন—বোধ করার ক্ষমতা, জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের ক্ষমতা, কোনো কিছু সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার, বিচার-বিবেচনা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, শরীর ও মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা, কল্পনা—উদ্ভাবন—সৃষ্টি করার ক্ষমতা প্রভৃতি বিভিন্ন মানসিক ক্রিয়ার শক্তি ও ক্ষমতা স্বরূপ।


বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডস্বরূপ ঈশ্বর শরীরের সমস্ত কার্যকলাপ— ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াতেই ঈশ্বর-মন ও ঈশ্বর-চেতনার প্রকাশ। আর, জীব ‘আমি’ হলো— সেই দিব্য-চেতন-মন-সিন্ধুর এক একটি বিন্দু স্বরূপ। ঈশ্বর-শরীরের অসংখ্য কোষের মধ্যে এক একটি কোষ সম। তবে, অন্যান্য কোষের সাথে এর একটু পার্থক্য আছে। জীব হলো— ঈশ্বর উপাদানে— ঈশ্বর সৃষ্ট জৈব কোষ।


এই মানব-চেতন-স্তরে— দুটি সক্রিয় মন নিয়ে আমাদের মনোজগত। একটি হলো— অবচেতন মন, যে অধিক অংশেই বিকশিত ও সক্রিয়। আর অপরটি হলো— সচেতন মন, যে স্বল্পাংশে বিকশিত ও সক্রিয়। এই সচেতন মনের যথেষ্ট বিকাশ ঘটলে, তবেই আমরা মানবোত্তর উচ্চ-চেতন-স্তরে উপনিত হবো। অবচেতন মন হলো— যুক্তি বিহীন আবেগপ্রবণ অন্ধ-বিশ্বাসী মন। সারা দিন-রাতের অধিকাংশ চিন্তা-ভাবনা-কল্পনা ও কর্মের পিছনে আছে এই মন। আর, সচেতন মন হলো— যুক্তি-বিচার-বিশ্লেষনসহ সত্যপ্রিয় মন। অবচেতন মনের কাজকর্মকে যুক্তি-বিচার-সতর্কতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা এবং পরিচালনা করাই এর কাজ। কিন্তু, অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই এই মনটি খুব সামান্য পরিমানে বিকশিত ও জাগ্রত, এবং অধিকাংশ সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকায়, তাদের সচেতন মন যুক্তি-বিচারের মাধ্যমে অবচেতন মনকে সবসময় যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে সক্ষম হয়না।


যে নিজেকে ‘আমি’ বলছে, সেতো আসলে ‘মন’-ই! তবে, কখনো অবচেতন-মন নিজেকে ‘আমি’ বলছে, আবার কখনো সচেতন-মন (মানব-চেতন-মন) নিজেকে ‘আমি’ বলছে। একে অপরকে দাবিয়ে রাখার আমিত্বের লড়াই চলছে— প্রায় সর্বক্ষণ। বেশিরভাগ সময়ে সবল অবচেতন-মন-ই জিতছে এই লড়াইয়ে। তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বল্প-বিকশিত দুর্বল সচেতন-মন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে কখনো কখনো।


অদৃশ্য এই মনদুটিকে যদি মূর্তরূপে দেখতে চান, তাহলে প্রচলিত ধর্মীয় ভাবনার বাইরে গিয়ে— মাকালী্র সেই ছবিটাকে মানসপটে অবলোকন করুন, যার পদতলে শিব শায়িত রয়েছে। এখানে, রণোন্মত্ত কালীই হলো অবচেতন মন। আর, তন্দ্রাচ্ছন্ন শায়িত শিব হলো সচেতন মন।


প্রত্যেক (চেতন স্তরের) মনের নিজস্ব স্মৃতি ভান্ডার আছে।অবচেতন মনের স্মৃতিচারণের সময় যদি সচেতন মন সজাগ থাকে, এবং আগ্রহী থাকে, তবেই সচেতন মন সেই স্মৃতি গ্রহন করতে এবং তার স্মৃতি-ভান্ডারে সঞ্চয় করতে পারবে। অবচেতন মন প্রায় সব সময়েই সজাগ থাকায়-- সে আগ্রহী হলে, সচেতন মনের স্মৃতি গ্রহন করতে সক্ষম।


সচেতন-মনের শাসনাধীনে থাকতে অবচেতন-মনের মোটেই ভালো লাগেনা। তবু নিরুপায় হয়ে থাকতে হয় তাকে। আমাদের নিদ্রাকালে, সচেতন-মন যখন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিদ্রিত হয়ে পড়ে, তখন বেশকিছু সময়ের জন্য অবচেতন-মন স্বপ্নরূপ কল্পনার পাখা মেলে দিয়ে— সম্পূর্ণতঃ বা অনেকাংশে স্বাধীনতা উপভোগ ক’রে থাকে। আমরা জাগ্রত থাকাকালেও, সচেতন-মনের তন্দ্রাচ্ছন্ন বা ঝিমুনো অবস্থায়, অথবা তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অবচেতন-মন নিজের খেয়াল-খুশিমতো কল্পনার জগতে অথবা বাস্তব জগতে অনেক কান্ডই ঘটিয়ে থাকে।


সচেতন মনের শাসন ব্যবস্থায় প্রায়শই অবচেতন মনের কোনো না কোনো ইচ্ছা বা চাহিদার অবদমন ঘটে চলেছে। এর ফলে, সুপ্ত থাকা হিংসা-বিদ্বেষ, কাম-ক্রোধ, নিষ্ঠুরতাগুলি সুযোগ পেলেই মাথাচারা দিয়ে উঠছে।

মন নিয়ে আরো দু-চার কথা

অস্থির মনকে স্থির-একাগ্র-শান্ত ক'রে তোলার উপায়--- বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি 'ধ‍্যান : আত্মসম্মোহন : যোগনিদ্রা' অধ‍্যায় গুলিতে। এখানে এখনো প্রকাশিত হয়নি।


এখানে এখন শুধু মনের স্বভাব--- আচরণ নিয়ে দু-চার কথা বলি: মনের যে অস্থিরতা আমরা উপলব্ধি করি, এই অস্থিরভাব আছে শুধু অবচেতন বা প্রাক-মানব-চেতন মনে। সচেতন মন অস্থির নয়। সে নিদ্রালু। তন্দ্রাচ্ছন্নতা হলো তার বর্তমান স্বভাব।


ধর্মভাবের বাইরে গিয়ে, কালী ও শিবের ছবিটি স্মরণ করো, এটাই হলো অবচেতন ও সচেতন মনের মূর্ত রূপ। সচেতন মন অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই এখনো পর্যন্ত খুব অল্প বিকশিত। অধিকাংশ সময়েই সে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েছে। মাঝে মাঝে একটু সজাগ হয়ে যখনই সে অবচেতন মনের দিকে দৃষ্টিপাত করে, তখনই অবচেতন মন সাময়িকভাবে সতর্ক হয়ে স্থির থাকে। ধরাপরার ভয়ে বা লজ্জায় জিভ কাটতেও পারে। আবার সচেতন মন অচিরেই তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়লেই --- অবচেতন মন তার লীলাখেলা শুরু ক'রে দেয়।


এই মন দুটিকে বুঝতে, আরো একটি চিত্রকল্প: ভাবুন, গ্রীষ্মের দুপুরে পরিশ্রান্ত মা তার দুরন্ত ছেলেটিকে নিয়ে শুয়ে আছে। ছেলে কিন্তু চোখ বুঁজে মটকা মেরে শুয়ে আছে। তার চোখ পিটপিট করছে। মা একটু চোখ বুঁজতে না বুঁজতেই, দামাল ছেলের দুরন্তপনা শুরু হয়ে যায়! এই হলো অবচেতন মন।


মন সর্বদাই নিজের ক্রিয়াশীল অস্তিত্ব বজায় রাখতে--- কোনো না কোনো বিষয়কে আঁকড়ে ধরে থাকে।মানস ক্রিয়াই হলো মন-অস্তিত্বের লক্ষণ বা নিদর্শন।অস্থির মন--- এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে, এইভাবে সে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ভ্রমণ ক'রে থাকে।মনকে প্রয়োজনমতো এক বিষয়ে ধরে রাখতে চাইলে, বিশেষ কিছু পদ্ধতি অভ‍্যাস করতে হয়। আর তার সাথে শরীর ও মন সুস্থ ক'রে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব‍্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।


মন--- নিজেকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারলে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে স্থির ও শান্ত হয়ে ওঠে। একেই বলে, আত্ম-ধ‍্যান। আত্ম-ধ‍্যানের মধ্য দিয়েই--- আত্মোপলব্ধী--- আত্মজ্ঞান--- আত্মশক্তি লাভ হয়ে থাকে।কোনো উপায়ে যেকোনো একটা বিষয়ের সাথে যুক্ত হয়ে--- তার অন্তঃস্থলে কেন্দ্রীভূত হতে পারলে, তখন মন সেই বিষয়ের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকা তথ্য---তত্ত্ব ও সত্যকে উন্মোচিত ক'রে, তার সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভে সক্ষম হয়।

কোনো স্থির বিষয়-বস্তু বা বিন্দুতে, অথবা কোনো একঘেয়ে সচল কিছুতে— সচেতন মন বেশিক্ষণ স্থির-একাগ্র হয়ে থাকতে পারে না। তার দুর্বলতার কারণে সে অচিরেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, এবং অবচেতন মন তার পছন্দের কর্মে— কল্পনা ও স্মৃতি চারণা এসবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।


তবে কোনোভাবে সচেতন মন এবং অবচেতন মন উভয়ই যদি ‘হিপ্নোটিক-স্টেট’-এ চলে আসে, তখন উভয় মনই স্থির-অ্চঞ্চল ও অসার অবস্থা প্রাপ্ত হয়। ধ্যানাবস্থা, আত্ম-সম্মোহন ও ‘হিপ্নোটিক-স্টেট’ হলো মনের এক বিশেষ অবস্থা— অস্বাভাবিক অবস্থা। এ’নিয়ে ধ্যান ও আত্ম-সম্মোহন প্রসঙ্গে ‘মহাবাদ’ গ্রন্থে আলোচনা করেছি।


মনের অসুস্থ অবস্থায়, অসুস্থতার রকমভেদে, সচেতন মন আরো বেশি দুর্বল ও তন্দ্রাচ্ছন্ন, অথবা গভীর নিদ্রামগ্ন হয়ে যেতে পারে। আর, অবচেতন মন— হতেপারে, আরো অস্থির— উত্তেজিত, বিকারগ্রস্ত, অথবা হতোদ্যম— বিষন্ন, নিরুৎসাহ, হতাশ বা শোকাহত। অবচেতন মনের অসুস্থ— বিকারগ্রস্ত অবস্থায়, সচেতন মন গভীর সুষুপ্তির মধ্যে ডুবে গিয়ে— প্রায় অনুপস্থিত অথবা একেবারেই অনুপস্থিত হয়ে থাকলে, ব্যক্তি উন্মাদ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। তখন অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রন করার মতো কেউ থাকেনা সেখানে।


আশাকরি, মনের গুরুত্ব, বিশেষকরে আমাদের জীবনে সচেতন মনের গুরুত্ব অনেকটাই উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে।


আরেকটি কথা, সচেতন মন--- কোনোকিছুর সঙ্গে মনোযুক্ত হলে, তখন অবচেতন মন আগ্রহের সাথেই হোক আর বাধ্য হয়েই হোক, সেও সেই বিষয়-বস্তুর সাথে যুক্ত হয়।এবার, সেই বিষয়-বস্তু যদি স্থির বা একঘেয়ে কিছু হয়, অথবা তার আগ্রহের কিছু না হয়, তখন অবচেতন মন চেষ্টা করে--- সেই বিষয়-বস্তু থেকে নিজেকে এবং সচেতন মনকেও বিচ্ছিন্ন করে--- তার নিজের (কল্পনার) জগতে ফিরে আসতে। আর, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে একাজে সফল হয়ে থাকে।

22 views0 comments
bottom of page